চলচ্চিত্র বা সিনেমা হল একটা তিলোত্তমা শিল্প। আর এই শিল্পের মেরুদন্ড হল তার আখ্যান বা গল্প। যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় চিত্রনাট্য। চিত্রনাট্য মাথায় রেখে তৈরি হয় সংলাপ। আর সেই সংলাপ চলচ্চিত্রে কলাকুশলীদের অভিনয়ে জীবন্ত হয়ে উঠলে আমরা মিল খুঁজে পাই বাস্তবের। প্রকৃতপ্রস্তাবে সিনেমা এবং বাস্তবের সম্পর্কটা অবিচ্ছেদ্য। বাস্তবের জমিতেই বোনা হয় চলচ্চিত্রের বীজ। দৈনন্দিন ঘটনা বা দুর্ঘটনা, রোজকার বা রোজগারের সমস্যা, মা-ছেলে, দাম্পত্য, বন্ধুত্ব, প্রেম-পরকিয়া থেকে শুরু করে জেলের কয়েদির সাথে মুক্তমনা নাট্য-নির্দেশিকার সম্পর্কের টানাপোড়েনও চলচ্চিত্রের বিষয় হয়ে উঠতে পারে। দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র খবর থেকেও চলচ্চিত্রকাররা খুঁজে নেন প্রাসঙ্গিক চলচ্চিত্র তৈরির বিষয়। গত ১৩ ই সেপ্টেম্বরের ‘দ্য টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া’ পত্রিকার ২, ৩ ও ৪ নং পৃষ্ঠায় প্রকাশিত চারটি প্রতিবেদনে উঠে আসা বিষয়গুলি লক্ষ্য করলেই দেখা যায় চলচ্চিত্র তৈরির ক্ষেত্রে সেগুলি কী ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। দ্য টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া – লিঙ্ক –
পৃষ্ঠা ১. epaperbeta.timesofindia.com//Article.aspx?eid=31812&articlexml=BRIDGING-THE-GAP-Compulsory-dose-of-courtesy-to-13092016002032
পৃষ্ঠা ২. epaperbeta.timesofindia.com//Article.aspx?eid=31812&articlexml=Accident-victims-son-raises-uneasy-questions-13092016002024
পৃষ্ঠা ৩. epaperbeta.timesofindia.com//Article.aspx?eid=31812&articlexml=Son-fails-to-crack-ISI-ex-govt-staffer-13092016003017
পৃষ্ঠা ৪. epaperbeta.timesofindia.com//Article.aspx?eid=31812&articlexml=Prisoners-wages-not-safe-Report-13092016004018
একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে MBBS পড়তে আসা প্রতিটি ডাক্তারকে পড়াশুনোর পাশাপাশি একটি বিশেষ ক্লাসে রোগীর আত্মীয়দের সাথে সহনাভূতিশীল, নমনীয় হওয়া এবং সাহচর্য্য বজায় রাখার পদ্ধতি শেখানো হচ্ছে। অদ্ভূতভাবে এই প্রতিবেদনটির নেপথ্যের চোরাস্রোতে বয়ে যায় ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘অলীক সুখ’ ছবির গল্পটি। যেখানে একজন সফল ডাক্তার ব্যক্তিগত বাহুল্যতা মেটাতে গিয়ে কর্তব্যের অবহেলা করেন, ফলস্বরূপ এক প্রশুতির মৃত্যু ঘটে জনৈক সেই ডাক্তারের বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতেই। এরপর সেই ডাক্তারের ভেতরের মানুষটার অনুশোচনা, আর বাইরের মানুষটার রূঢ়তার দ্বন্দ্ব নিয়ে এগিয়ে চলে এই ছবির গল্প। অন্য আরেকটি প্রতিবেদনে রয়েছে পথ দুর্ঘটনায় মায়ের মৃত্যুতে দিশাহারা, হতভাগ্য এক পুত্রের কতৃপক্ষের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া কিছু প্রশ্ন- তার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে ? শুধুই কি গাড়ির চালক ? কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশটি ? নাকি খোদ কতৃপক্ষ ? যাদের উদাসীনতায় মানুষ কেবল মানুষ হারায়। ২০১২-র ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ সিনেমাটিও এই পথ দুর্ঘটনার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়। যেখানে এক হতভাগ্য বাবা হারায় তার সন্তানকে। আর তারপর খুঁজতে থাকে দোষী কে ? বাস চালক? বাস মালিক ? বাস কোম্পানি ? নাকি খোদ কতৃপক্ষ ? সেই এক প্রশ্ন বাস্তবের ময়দান ছেড়ে উঠে এসে আঙুল তোলে রূপোলি পর্দায়। কারণ, ‘সব দোষ পথচারীর নয়’। নজর কাড়ে ‘দ্য টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া’ পত্রিকার ৩ য় পৃষ্ঠার আরেকটি বীভৎস প্রতিবেদন। যেখানে ষাটোর্দ্ধ এক পিতা, পুত্রের ISI এন্ট্রান্সের ব্যর্থতায় মানষিক স্থিতি হারিয়ে, স্ত্রী ও পুত্রকে কুপিয়ে খুন করার চেষ্টা করেন ও নিজে আত্মহত্যা করেন। সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যত আশা করতে করতে এক সময় অভিভাবকেরা চাপিয়ে ফেলেন উচ্চাশার বোঝা, আশা রূপান্তরিত হয়ে যায় দাবীতে। সন্তানদের (সে যে বয়সেরই হোক) ব্যক্তিগত জীবনের বাতাসটুকুও একসাথে টানতে চান অভিভাবকেরা। আর ঠিক এখানেই শুরু হয় টানাপোড়েন। প্রবল উচ্চাশার থেকে সৃষ্টি হয় মানসিক বিষাদের। মনে পড়ে যায় এরকমই রূঢ় বাস্তব নিয়ে তৈরি ২০১১-র ‘ইচ্ছে’ ছবিটির কথা। যেখানে মায়ের স্বপ্ন পূরণের অত্যাচারে দেওয়ালে পিঠ ঠিকে যাওয়া ছেলের মনে তৈরি হয় প্রতি-হিংসা। নজর দেওয়া যেতে পারে ‘দ্য টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া’ পত্রিকার অন্য আরেকটি প্রতিবেদনে। যেখানে আলোচনা করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সংশোধনাগারগুলিতে সশ্রম বন্দীদের অপর্যাপ্ত বেতন নিয়ে। এর পাশাপাশি এখানে বলা হয়েছে সংশোধনাগারগুলিতে সংখ্যা বাড়ছে বন্দীদের। অর্থ্যাৎ অপরাধও বাড়ছে সমানুপাতিক হারে। একটু ভাবলেই বাস্তবের এই সমস্যার প্রতিফলন এবং অন্ধকার থেকে তার আলোয় উত্তরণের দিশা দেখতে পাই ২০১২-র ‘মুক্তধারা’ ছবিটিতে। মজার বিষয়টা হল চলচ্চিত্রকারদের বাস্তব পরীক্ষণ। চলচ্চিত্রে কখনো কখনো তাঁরা বাস্তবের সত্যকে তুলে ধরেন, আবার কখনো কখনো সম্ভাব্য বাস্তবের আভাস দেন। যেরকম বলা যেতে পারে ‘অলীক সুখ’, ‘অ্যাক্সিডেন্ট’, ‘ইচ্ছে’, ‘মুক্তধারা’ সিনেমাগুলি তৈরি হয়েছিল ‘দ্য টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া’- য় প্রকাশিত প্রতিবেদন গুলির অনেকদিন আগেই। বাস্তব সংক্রান্ত বিষয় থেকে চলচ্চিত্র ভাবনার এই ধারাও চলে আসছে বহুদিন আগের থেকেই। শুধুমাত্র রুখা সুখা বাস্তবকে তুলে ধরাই নয়, চলচ্চিত্রকাররা তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে অনেক সময় দিয়ে যান সমাধানের পথ কিংবা ইতিবাচক ইঙ্গিত। বাস্তবের এমন চলচ্চিত্রায়নের জন্য পরিচালক নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের যে সাধুবাদ প্রাপ্য একথা বলাই বাহুল্য।
© windowsproductions.com. All Rights Reserved
Top wpDiscuz